আমার কথা
শ্রী আনন্দমোহন চক্রবর্তী
সভাপতি, পরিচালন সমিতি
মাল আদর্শ বিদ্যাভবন
একটা গানের প্রথম দুলাইন লিখে আমার কথা বলছি –
"আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে"।।
মাল আদর্শ বিদ্যাভবন সম্পর্কে আমার মনোভাব উÜ«ত দু-লাইনের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়। কি যে অদৃশ্য আকর্ষণ আমি নিজেও বুঝতে পারিনা। তবে এটা সম্পূর্ণ সত্য। মাল আদর্শ বিদ্যাভবন আমার যৌবনের উপবন ও বার্ধক্যের বারাণসী। আজ জীবন সায়াহ্নে উপনীত হয়ে কেন যেন একবার অতীতকে ফিরে দেখার তাগিদ অনুভব করছি। আমি এই বিদ্যালয়ের ছাত্র নই। কর্মসূত্রে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করা। আমি যখন এই বিদ্যালয়ে যোগদান করি তখন বিদ্যালয় বাল্যবস্থা থেকে কৈশোরে পদার্পণ করেছে, আর আমি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছি। বিদ্যালয় ও আমার বয়স প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের মধ্যে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল যে সখ্যতা আজও অমলিন। আমার প্রথম কর্মস্থল ডামডিম গজেন্দ্র বিদ্যামন্দির। কিন্তু সেখানে আমি কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। কেবলই ভাবতাম মাল আদর্শ বিদ্যাভবনে কাজের সুযোগ পেলে আমি চলে যাবো। আমার স্বর্গীয় পিতৃদেব প্রায়ই বলতেন “যে যা চায় সে তা পায়”। অর্থাৎ “যাদৃসি ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃসি”। আমার জীবনেও তাই ঘটলো। আমার ভাবনাই বাস্তবে পরিণত হলো। আমি আদর্শ বিদ্যাভবনে কাজের সুযোগ পেয়ে ডামডিম স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম। ডামডিম স্কুল থেকে চলে এলেও অনেক প্রতিকূলতা সত্বেও শিক্ষক হিসাবে আমার প্রতিষ্ঠা কিন্তু ডামডিম স্কুল থেকেই। তবুও মাল আদর্শ বিদ্যাভবন আমার রক্তে মিশে আছে। কেন জানিনা। বিদ্যালয়ের জন্য কিছু করতে পারিনি কিন্তু বিদ্যালয় থেকে যা পেয়েছি তা অভাববনীয়। এখানে এসে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের সাথে কাজ করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু পরবর্তী সব প্রধান শিক্ষকের সাথে কাজ করেছি। তাছাড়া যে সমস্ত ঋষি তুল্য শিক্ষকদের পেয়েছি তাতে আমি ধন্য। তাদের সাহচর্য কোনদিন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার সন্তানদের আমি জন্মদাতা পিতা, কিন্তু ওদের দেহ ও মনের সার্বিক বিকাশ আমার বিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ সাহচর্য। এদিক থেকে দেখলে আমার বিদ্যালয় যেন ওদের ধাত্রী স্বরূপ আর আমার অভিভাবক। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে আজ মনে পড়ে প্রাচীন আর্য-ঋষিদের সেই কথা “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা ও আত্মানং বিদ্ধি”। অর্থাৎ নিজেকে জানো। আমরা আজ সভ্যতার বড়াই করি। আধুনিক সভ্যতার এটাই বুঝি সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা যে আমরা নিজেকে জানিনা বা জানার চেষ্টাও করি না।
আদর্শ বিদ্যাভবন শিক্ষার আদর্শ পীঠস্থান। এখানে দেহের বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব নেই। কারণ দেহ ও মনের সুসম বিকাশ না হলে কোন মহৎ কাজই করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমরা জানি যে “A healthy mind lives in a healthy body” জাতির মেরুদন্ড যে শিক্ষা তার জন্য সর্বাগ্রে দরকার সুষ্ঠ সবল শরীর। স্বল্প পরিসরে সমস্ত ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
যাক সে কথা। বিদ্যালয়ের ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ অর্থাৎ ২৩/০১/২০২৩ তারিখ। বিদ্যালয়ের বর্তমান যে নতুন তিন তলা ভবনে যে নব কলেরবে সেজেছে এর মূলে আছে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র তথা বর্তমান মাল পৌরসভার পৌরপিতা স্বপন সাহার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। কয়েক বছর আগেও বিদ্যালয়ের যে জীর্ণ কলেবর ছিল তাতে গীতার কথায় মনে হচ্ছিল “জীর্ণানী বাসাংসি যথা বিহায়” তবে কি বিদ্যালয়ের অন্তিম সময় এসে গেল? না বর্তমান নব কলেবরে নবযৌবন লাভের পর মনে হচ্ছে যোগী ঋষিদের সেই “Transmigration of Soul” এর কথা। প্রাণীর যেমন মৃত্যু হয় না, আত্মা জীর্ণ দেহ পরিবর্তন করে মাত্র। সেরূপ ভেবে আনন্দ পাই যে আমার বিদ্যালয়ও নতুন নতুন দেহ পরিবর্তন করে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। প্রাণীকুল যেমন বেচে থাকে তাদের সন্তান সন্ততির মাঝে ঠিক তেমনি ভাবে Grey-র মতো কোনদিন আমাদের বলতে হবে না “Some in glorious Milton may rest here” বা দীনেশচন্দ্র সেনের মত আক্ষেপ করতে হবে না যে “মনসুর বয়াতির মত কত পল্লী কবি বাংলার আনাচে কানাচে রয়েছে তার খবর কে রাখে“। আমার বিদ্যালয় চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। ওরকম আক্ষেপ করতে হবে না। কালের নিয়মে আমরা যখন নক্ষত্র লোকের বাসিন্দা হয়ে যাব তখন বহুদূর থেকে আমার অভিভাবক বিদ্যালয়কে নবযৌবনে দেখে আনন্দ উপভোগ করব। যে মহৎ ব্যক্তিত্বের জন্মদিনে আমার বিদ্যালয়ের জন্ম তারই মত আমার বিদ্যালয়ও চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। তাই সেই মহান ব্যক্তিত্বের পায়ে কপাল ঠেকিয়ে Browning সাহেবের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে আমারও আজ বলতে এচ্ছে হচ্ছে “Today is the day of days in my life”. জয়তু দুই অন্তর দেবতা, জানাই তোমাদের শত কোটি প্রণাম।
সব শেষে যে কথাগুলো না বললে আমার কথা অসমাপ্ত থেকে যায় তা হচ্ছে প্রাচীন গুরুকুল শিক্ষা ব্যবস্থা আমি দেখিনি ও তখনকার গুরুদের সান্নিধ্যও কোনদিন ভাগ্যে জোটেনি। কালের নিয়মে দিন ও সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যেও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ঋষি তুল্য যে কজন শিক্ষাগুরুকে দেখেছি বা সান্নিধ্য লাভ করেছি, এবং যাদের কাছে নিজেদের বৈভব বুদ্ধির চিন্তা চেয়ে প্রয়োজনে তিরস্কার ও পুরস্কারের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষ চিন্তাই ছিল লক্ষ্য। এদের মধ্যে স্বর্গীয় রাইমোহন গোস্বামী, স্বর্গীয় তারাকান্ত মিত্র ও স্বর্গীয় লক্ষণ ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখ করে জানাই আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম ও তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় ঈশ্বরের কাছে জানাই আন্তরিক প্রার্থনা।